মার্চের ১৪ তারিখ। গন্তব্য White Rann. এই হোয়াইট রান কি জিনিস এখনো জানি না। মুন্দ্রার যে লোকগুলো ট্যুরিজম লোকেশান সাজেস্ট করেছে, তারাই এই নামটা প্রথম বলেছে।
মরুভূমির মাঝে রাস্তা। ডান পাশে ধূ ধূ বালি আর বাম পাশে ন্যাশনাল গ্রীডের লাইন। মাঝে মাঝে দেখা মেলে রাখালদের। শত শত গরু, মহিষ অথবা ভেড়ার পাল নিয়ে ধূলো উড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে হেসে খেলে। এত বিশাল খোলামেলা রাস্তায় কেন সর্বোচ্চ স্পীড লিমিট ৩০ কিমি ইন্ডিকেট করা আছে জিজ্ঞাসা করাতে ড্রাইভার ইউসুফ জানাল, রাতে সব গরু, ছাগল, মহিষ রাস্তার উপরেই ঘুমায়, তাই ড্রাইভাররা যাতে হঠাথ ব্রেক করতে না হয় সেজন্যই সতর্কতা।
পথে ইউসুফ একটা ছোট স্টেশনে থামাল, বলল এই এলাকার একটা জনপ্রিয় মিষ্টান্ন রয়েছে। না খেলে মিস করব। মিষ্টি ইদানীং তেমন পছন্দ করি না, তথাপিও আগ্রহ নিয়েই অর্ডার দিলাম। ওয়ান টাইম প্লাস্টিক বক্সে ১০ রুপীর দিল। খেলাম। অতি মিষ্টি। ১ রুপী দিয়ে ওয়ান টাইম পানি খেলাম।
একটা বিষয় খেয়াল করলাম, যতই সামনে আগাচ্ছি, ততই মুসলমানের সংখ্যা বাড়ছে এবং সবার পরিধান কৃত কাপড় পাকিস্তানীদের মতই। ঘটনা কি? জিজ্ঞেস করাতে বলল, হোয়াইট রানের আশে পাশে প্রায় সব মুসলমান এবং পাকিস্থানী সংস্কৃতি কিছুটা প্রকট।
হোয়াইট রেন থেকে ৩০ কিমি দূরে টিকেট কাউন্টার, বিকেল ৫ টায় শেষ সময় টিকিট কাটার। আমি পৌঁছাতে পৌঁছাতে ৫ মিনিট লেট (মিষ্টির লোভ)। অনেক রিকোয়েস্টে মূল গেইটে ওরা ফোন করে জানিয়ে দিল।
এখন পর্যন্ত জানিনা, মূল গেট কেন বা কি। যখন গেটে পৌঁছালাম তখন দেখি বিএসএফ বন্দুক তাক করে আটকে আছে। মূলত হোয়াইট রান এলাকাটি পাকিস্তানের পার্শ্ববর্তী, পাকিস্তানীরা যাতে এই এলাকা দখল করে নিতে না পারে, তাই প্রচন্ড সতর্কতা।
গেইটের পাশেই অনেক গুলো ছোট ছোট কটেজ মিলে একটা ইকো রিসোর্ট। অফ সিজন তাই বন্ধ। সিজনে ভাড়া কমবেশি ৭/৮ হাজার রুপী।
তখন পর্যন্ত আমি জানতাম না রাতে কোথায় থাকব। আল্লাহ ভরসা, ইউসুফ সাথে আছেই।
আমার জন্য ২০০ রুপী (পাসপোর্টের ফটোকপি অথবা আধার (ভারতীয় ন্যাশনাল আইডি) কার্ড ছাড়া টিকেট দেয় না), গাড়ির জন্য ৫০ রুপী দিয়ে টিকেট কেটে সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম।
হোয়াইট রানে পৌঁছে অবাক এবং বিস্ময়ে বধির হয়ে আছি, একি! এ যে লবণ! ইন্ডিয়ানদের ভাষায় ‘নিমক’!
আসলেই তাই। বিস্তীর্ণ লবণের সমুদ্র। চারদিকে সাদা!
সন্ধ্যা ৮ টার দিকে সূর্য আংকেল ঢলে পড়ল, চাঁদ আন্টি উড়াল দিল। রাতের ৯ টা ৩০ পর্যন্ত জোছনার খেলা দেখলাম। ১০ টায় বন্ধ করে দেয় বিএসএফ। বের হলাম, এবার কই যাব?
সামনের দিকে যাচ্ছি তো যাচ্ছি। মরুভূমির বিরান ভূমি। কিছুদূর যেতে গিয়ে দেখি একটা ইকো রিসোর্ট। একটাই লাইট জ্বলছে। গিয়ে দেখলাম, কোন গেস্ট নাই। ৫/৬ টা ঘর মিলে একটাতে থাকতে হবে, ভয়ে আছি না জানি কোন অঘটন হয় কিনা। এর মধ্যে ইউসুফ জানাল, ওর বাড়ি এই জায়গা থেকে ৪০ কিমি দূরে, সে বাড়িতে যেতে চায়।
আমি বললাম, প্রয়োজনে আমিও যাব, তবুও তোমাকে ছাড়ছি না। রিসোর্টের মালিক স্থানীয়। আসলেন- ৩ হাজার রুপী চাইলেন। আমি ৫০০ রুপী বললাম। শেষ মেষ ১০০০ হাজার রুপীতে রাজি হলাম উইথ ডিনার এন্ড ব্রেকফার্স্ট।
ঘন্টাখানেক পরে ৬ জনের একটা গ্রুপ আসল, ওরা শুধু রাতের খাবার খাবে। মনে মনে ভাবলাম, ভালই হলো।
কিন্তু একি! খাবার আসল শুকনো রুটি এবং ঘি! মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল! এগুলোও খাবার হয়!
আমি বলতে গেলে কিছুই খেলাম না, সবাই দেখি ৭/৮ টা করে রুটি ঘি দিয়ে মেখে মেখে খাচ্ছে। ওরা খুবই আহত হলো, আমার এই অবস্থা দেখে। বিশেষ করে ইউসুফ।
রাতে ঘুমিয়েছি, ঘুম বলতে গেলে নাই। কে না কে আসে এই বিরান ভূমিতে! রাত ৪ টার দিকে হঠাত মোটর সাইকেলের শব্দ। রুমের ছোট জানালার ফাঁক দিয়ে দেখি, তালেবানের মত জোব্বা পরা ৩ জন নামল এরপর পাশের দিকে কোথায় গিয়ে যেন বিভিন্ন ধরনের আওয়াজ করছিল। আমার সার্ভারে যত টাইপের দোয়া আছে, মনে প্রাণে পড়তে লাগলাম, এক সময় ফজরের আজান দিল। ইউসুফকে জাগালাম, সে গিয়ে রিসোর্টের ছেলেটাকে জাগাল। বাইরে বের হয়ে দেখলাম, সেই ৩ জন ইটের শ্রমিক। গতকাল কাজ করে নাই, তাই আজকে ভোর রাত থেকে কাজ করে কাভার করে দিচ্ছে!
হোয়াইট রানের অনুভূতি খুব ভাল, শুধু রাতটা ছাড়া। এর মধ্যে একটা কথা বলা হয় নাই। রুমে ঢুকে দেখি একটা খাট-ডাবল বেড। ড্রাইভারকে যেহেতু আমি ছাড়ি নাই, ওকে কোথায় রাখি। আবার ও ড্রাইভার, কিন্তু আমার মতই মানুষ। চিন্তা করে ডিশাসান নিলাম, ইউসুফকে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে বললাম, আমি হোটেলের চাদর গায়ে দেই না, আমার নিজস্ব আছে ইত্যাদি বলে ওকে খাটেই রাখলাম। আমি বাইরে থেকে একটা খাটিয়ার মত এনে নিজের বেডশিট, বালিশ কাভার দিয়ে রাত পার করলাম।
যেখানে বাঘের ভয়, রাতটা আসলে ঠিক সেখানেই হয়।