মানুষের বয়স ৬০০০ বছর। যিশুর জন্মের পর থেকে ইংরেজী সালের হিসাবে ২ হাজার বছর, এর পূর্বের তথ্য, উপাত্ত, ধর্মীয় পুস্তক, ফসিল, পুরোকীর্তি, বৈজ্ঞানিক গবেষণা- সব কিছু মিলে যিশুর জন্মের পূর্বে ৪ হাজার বছরেই যে পৃথিবীতে প্রথম মানুষ হযরত আদম(আ) এবং মা হাওয়া (এ্যাডাম এন্ড ইভ) এসেছিলেন সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়।
পৃথিবীর প্রাচীন জনপদ বা বসতস্থল বলা হয় মধ্যপ্রাচ্য এবং ভূমধ্যসাগর অঞ্চলকে। আজকের পৃথিবীতে যখন শাসন করছে আমেরিকাওয়ালারা, যাদের বয়স হয় নি এখনো ৭০০ বছর।
বলা হয়, পৃথিবী থেকে বেহেশতের সবচেয়ে নিকটবর্তী স্থান মসজিদুল আকসা যা জেরুসালেমে অবস্থিত। এই কারণেই আমাদের ইসলামের নবী এ করীম (সাঃ) এই স্থান থেকেই বেহেশতে ‘মেরাজের’ মাধ্যেমে সাত আসমান ভেদ করে আল্লাহর দরবারে গিয়েছিলেন।
ডোম অব দ্য রকের পাশেই মসজিদুল আকসা (আরবি: المسجد الاقصى) (আল-আকসা মসজিদ বা বাইতুল মুকাদ্দাস নামেও পরিচিত) ইসলামের তৃতীয় পবিত্রতম মসজিদ। এটির সাথে একই প্রাঙ্গণে কুব্বাত আস সাখরা, কুব্বাত আস সিলসিলা ও কুব্বাত আন নবী নামক স্থাপনাগুলো অবস্থিত। স্থাপনাগুলো সহ এই পুরো স্থানটিকে হারাম আল শরিফ বলা হয়। এছাড়াও স্থানটি “টেম্পল মাউন্ট” বা ‘ডোম অব দ্য রক’ বলে পরিচত এবং ইহুদি ধর্মে পবিত্র বলে বিবেচিত হয়।
ইতিহাসবিদ পণ্ডিত ইবনে তাহমিয়ার মতে ,
আসলে সুলাইমান(আ) এর তৈরি সম্পূর্ণ উপাসনার স্থানটির নামই হল মসজিদুল আল-আকসা ।
ম্বাইতুল মুকাদ্দাস মুসলমানদের প্রথম কেবলা।
জেরুসালেমকে বলা হয় পৃথিবীর কেন্দ্র। কারণ এই স্থানটিতে প্রায় সব ধর্মের নবী রাসূলের সম্মিলন হয়েছিল।
‘’৬০০ খ্রিস্টাব্দের পরে জেরুসালেম সহ অর্ধেক পৃথিবীর অধিকর্তা, রোম সম্রাট হেরাক্লিয়াস মহানবীর চিঠি পেয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে সভাসদদের সাথে আলোচনা করছিলেন। এমন সময় তিনি ৬২১ খ্রিস্টাব্দে ঘটা একটি ঘটনা সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিলেন-
জেরুসালেমের প্রধান পুরোহিত তাকে জানালেন, টেম্পল মাউন্টের সব দরজা বন্ধ করেই আমি ঘুমাতে যাই, কিন্তু সেদিন দ্বাররক্ষীরা হতদন্ত হয়ে ছুটে এসে জানায়, আজকে পূর্ব দিকের দরজা কোনভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না!
কারণ কি? সবাই মিলে সর্বশক্তি দিয়েও সে দরজা একচুল নাড়ানো গেল না, বন্ধ তো দূরে থাক। দরজা পাথরের মত স্থির এবং শক্ত। তিনি রক্ষীদের বললেন, কিছুই করার নেই। তবে সবাই সাবধানে থেক।
পুরোহিত আন-নাতুর বলেছেন, সেদিন রাতে খুব ভাল ঘুম না হওয়ায় খুব ভোরে গিয়ে দেখেন – দরজার বাইরে যে শেঁকল বাধার পাথর, সেটিতে অবিশ্বাস্যভাবে ছিদ্র করা যেন কেউ ঘোড়ার রশি বেঁধে রেখেছিল।
সবশেষে তিনি এই মতামত দিয়েছিলেন- পৃথিবী থেকে নিশ্চয় কোন মহা সম্মানিত বুজুর্গ প্রয়োজনে আসমানে উঠেছিলেন; কারণ পৃথিবী থেকে আসমানে যাওয়ার আলৌকিক সিঁড়ি শুধু এই পবিত্র টেম্পলেই আছে- যার সাথে আর্ক অব কোভেনান্টের যোগাযোগ।‘’
ইহুদী, খ্রিস্টান, মুসলমান এই তিন ধর্মেরই পবিত্র স্থান ডোম অব রক। কারণ তিনটি ধর্মই কিতাবী ধর্ম। কিন্তু, মহানবী (সাঃ) যখন কুরআন নিয়ে আসলেন, তখন মহান আল্লাহ ইসলামকে মনোনীত দ্বীন এবং রাসূল(সাঃ) কে সর্বশেষ নবী ঘোষণা করে বাকি সব পূর্বের ধর্ম এবং কিতাবকে বায়েজাপ্ত ঘোষণা করেন (কুরআন ছাড়া সব আসমানী কিতাব বিকৃত হয়েছে)।
আল্লাহ পাক তাঁর কিতাব কুরআন মজীদে এরশাদ করেছেনঃ
إِنَّ الدِّينَ عِنْدَ اللَّهِ الْإِسْلامُ
‘নিশ্চয় আল্লাহর কাছে একমাত্র মনোনীত দ্বীন হলো ইসলাম।’ (আল ইমরান, ৩ : ১৯)
وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلامِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ
‘কেউ যদি ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দ্বীন চায় তা কখনো গ্রহণযোগ্য হবে না।’ (আল ইমরান, ৩ : ৮৫)
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلامَ دِينًا
‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করলাম। আমার নেয়ামতকে তোমাদের উপর পূর্ণতা দিলাম আর তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম।’ (মায়েদা, ৫ : ৩)
এর পরিষ্কার অর্থ- মহানবী (সাঃ) এর মেরাজের স্থান জেরুসালেম এবং ডোম অব দ্য রক শুধুই মুসলমানদের পবিত্র স্থান কারণ, মেরাজেই পূর্ববর্তী সকল নবী রাসূল মুহাম্মদ (সাঃ) কে নবীদের শ্রেষ্ঠ বলে সালাম জানিয়েছেন।
একই সাথে ৬০০ শতকের পর ফিলিস্তিন, মিসর, ইরাক, ইরান, লিবিয়া, তুরস্ক সহ দেশের পর দেশ, জনপদের পর জনপদ ইসলামের ছায়াতলে এসেছে, পবিত্র স্থানের মালিক সেসময়ের ধর্মান্তরিত ফিলিস্তিনি জনগণই।
ডোম অব দা রক গড়েছিলেন হযরত সুলায়মান(আ) যিনি পশুপাখীর ভাষা বুঝতেন, যিনি ইন্তেকাল করার পরেও আল্লাহর কাজে রিকোয়েস্ট করে এই পবিত্র উপাসনালয় নির্মাণ পর্যন্ত লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
যুগে যুগে হযরত ওমর(রা), খলিফা আবদুল মালেক, গাজী সালাহ উদ্দিন আইয়ুবী, অটোম্যান সুলতান সুলেমান, সর্বশেষ জর্ডানের বাদশার হাতে এই ডোম অব দ্যা রকের সৌন্দর্য আকাশ চিরে বিদীর্ন হয়েছিল।
এই ডোম অব রকে মুসলমান ছাড়া অন্য কোন ধর্মের লোকের প্রবেশ নিষেধ, কারণ তাওরাত অনুসারে এটি পাপ, পবিত্র স্থানে জনবসবাস পবিত্র স্থানের পবিত্রতা ভঙ্গ করে। একমাত্র ঈসা (আ) মসীহ যখন আবির্ভাব হবেন, তিনিই প্রবেশ করতে পারবেন। এই ডোম অব দ্যা রক নিয়ন্ত্রিত হয় একটি ইসলামী ওয়াকফ ট্রাস্টের মাধ্যেমে জর্ডানের সদর দফতর থেকে।
বহু বিচিত্র, পৃথিবীর সমান্তরাল ইতিহাস সমৃদ্ধ এই পবিত্র স্থানের বহু কথার মধ্যে এই পর্বে জানাব শুধু মহান সুলতান সুলেমান খান ম্যাগনিফিশেন্টের অবদানের কথা। পরের পর্বগুলোতে ধীরে ধীরে আলোচনা হবে বিস্তারিতভাবে।
এই আলৌকিক পবিত্র স্থাপনার অষ্টভুজ তৈরী করেছিলেন খলিফা আবদুল মালেক। এরপর নানা প্রতিকূলতা পরে ১৫৩৭ সালে তুরস্কের সুলতান সুলেমান জেরুসালেমে আসেন। তিনি শ্রীহীন, রুক্ষ, সাদামাটা হারাম-আস-শরীফের চেহারা দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। কনসটান্টিনোপোল যার রুপান্তরিত নাম ইস্তাম্বুলের স্বর্ণালী স্থাপনার কথা ভেবে ভেবে তিনি প্রকৌশলীদের ডেকে নির্দেশ দেন। সুলতান সুলেমানের প্রত্যক্ষ নির্দেশে জেরুসালেমের এই পবিত্র স্থানকে নীল ইজমিরের টাইলস দিয়ে বাঁধানো হয়, ডোমের নীচের অংশ পবিত্র কুরআনের ক্যালিওগ্রাফি দিয়ে মুড়িয়ে দেওয়া হয়। এমনকি পবিত্র জেরুসালেম নগরীকে তিনি চল্লিশ ফুট উঁচু দেওয়াল যা আট ফুট প্রস্থ এবং দৈর্ঘ্য আড়াই কিলোমিটার প্রাচীর দিয়ে সুরক্ষিত করে দেন, যার তুলনা চলে চীনের মহাপ্রাচীরের সাথে।
তিনি উপস্থিত প্রকৌশলী, নির্মাণকারীদের বলেছিলেন-
‘’আমি চাই জেরুসালেমকে সুন্দরী নারীর কৌমার্য রক্ষার মত দৃঢ় দেয়াল দিয়ে ঘিরে দিতে হবে। সেই দেয়াল- যা শুরু করেন আমার নামেই নাম বাদশাহ সুলায়মান(আ), দৃঢ় করেছিলেন হোরেড দ্যা গ্রেট এবং সম্মানিত করেছিলেন সুলতান সালাহ উদ্দিন আইয়ুবী; যার সমাপ্তি টানব আমি- ওসমানের পবিত্র তরবারীর স্পর্শে। এ নগরী হবে সকল দস্যু, তস্কর, লুটেরা এবং হামলাকারী থেকে নিরাপদ। আমার দেয়াল হবে সকল ধর্ম, বর্ণ, গোত্র এবং বিভেদের উপরের সেই মজবুতি- যা ইতিহাসের অংশ হবে না, বরং নিজেই ইতিহাস হবে’’
জেরুসালেম সমগ্র বিশ্বের রাজনীতি, ধর্মনীতি, বিভেদ, যুদ্ধ, সম্মান এবং চিরঞ্জীবের মূল প্রতীক।
ওআইসি থেকে গতকাল জেরুসালেমকে ফিলিস্তিনের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে এবং পৃথিবীর রাষ্ট্র সমূহকে আহবান জানানো হয়েছে সে ঘোষণায় সমর্থন দিতে। যদিও ঈমাম মাহাদী পর্যন্ত মুসলিম উম্মাহর বিশৃঙ্খলা অব্যহত থাকবে, তবুও এরদোগানের বলিষ্ট কন্ঠ তিমির রাতের আঁধার কেটে আলোর চিহ্নের আভাস ফুটিয়ে তোলে।
–ইমরুল শাহেদ
তথ্যসূত্রঃ
১. জেরুসালেম, বুলবুল সরওয়ার
২. মজলুম ফিলিস্তিনীবাসীদের রক্তের স্বাদ
৩. বিভিন্ন ওয়েবসাইট