দ্য লোনলি ট্রাভেলার

Krabi (ক্রেবি)র পদপ্রান্তে কৃত্রিম পাখির চাকাগুলো যখন স্পর্শ করছিল, ভোরের সূর্য তখন সকাল ৮ টায় এসে স্থির। যদিও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির কারণে সন্ধ্যার আবেশ বুলিয়ে দিয়েছিল প্রকৃতিকে সূর্য মামার অনুপস্থিতে।

ব্যাংকক থেকে ফ্লাইট ছিল সকাল ৬ টায়। ভোর ৪ টায় ডরমেটরি ছেড়ে বেরিয়ে হেলেদুলে যখন ঘুমঘুম চোখে এয়ারপোর্টে বোর্ডিং পাস নিয়ে নির্দিষ্ট গেইটের খোঁজে যাচ্ছিলাম, সমগ্র এয়ারপোর্টের সাউন্ডবক্সে গমগম করে উঠল, মিঃ ইমরুল, আপনি অতি দ্রুত ২৩নাম্বার গেইটে পৌঁছান, গেইট ক্লোজড হয়ে যাচ্ছে৷ এখনো ৩০ মিনিট বাকি ৬ টা বাজতে, বিস্মিত আমি যখন সামনের দিকে দৌড়াচ্ছি, দেখি উল্টা দিক থেকে এক নারী দৌড়ে আসছে।  আমার নাম জিজ্ঞেস করে ফলো মি বলে নিয়ে চলল ২৩ নাম্বার গেইটের দিকে। 

আমাকে অবাক করে দিয়ে ঠিক ৫.৪৫ মিনিটে বিমান স্টার্ট দিল, ঠিক ৬.০০ টায় উড়াল দিল। কি অদ্ভুত সময়জ্ঞান এদের! একটুর জন্য ফ্লাইটই মিস করেছিলাম আজকে।

আপনারা ভাবতে পারেন থাইল্যান্ডে এসে ক্রেবিতে কেন গেলাম অন্যান্য ফেমাস স্টেইট গুলোতে না গিয়ে। আসলে আমার রুটটা ছিল কোস্টাল এরিয়া। থাইল্যান্ডের উত্তর দিক মানে আমাদের ককসবাজার থেকে খুলনা অঞ্চল পর্যন্ত যেমন সী লাইন ধরা হয়, তেমনি আমিও ক্রেবি থেকে ফুকেট পর্যন্ত সী লাইনটা ঘুরে দেখতে চেয়েছিলাম ৭/৮ দিনে।

ক্রেবি এয়ারপোর্ট থেকে শেয়ারে মাইক্রো পাওয়া যায়। শুধু কোন হোটেলে যাব সেটি দেখালেই নির্দিষ্ট হোটেলের সামনে নামিয়ে দেয়। লেটেস্ট মডেলের সে মাইক্রোতে ১ ঘন্টার পথের ভাড়া নেয় ১৫০ টাকার মত। 

মেঘ, কুয়াশা আর বৃষ্টির কারণে আকাশ থেকে ক্রেবিকে আন্দাজ করা যায়নি, কিন্তু বিশাল ৮ লেন রাস্তা ধরে যেতে যেতে একে ককসবাজার বলেই ভ্রম হচ্ছিল। দূরে দূরে সুউচ্চ পাহাড় আর গাছের সারি। সমস্ত পথের ডিভাইডারে জারুল ফুলের মাখামাখি। যদিও বর্ষায় এ কোন প্রকারের জারুল ভেবে পাচ্ছিলাম না। 

শহরে প্রবেশ করেই একটু প্রশান্তি অনুভব করলাম মসজিদের মিনার দেখে। বুঝাই যাচ্ছে এই অঞ্চলে মুসলিম আধিক্য বেশি। ভ্রমণে আমি ধর্ম-বর্ণ-রং-বয়সের ঊর্ধ্বে,  তবুও খাদ্যেভাসের সুবিধার জন্য একটু প্রেফার চাই মনে মনে মাঝে মাঝে। 

ভেজা, ঝকঝকে তকতকে শহরের শেষ প্রান্তে আমার হোটেলের সামনে যখন নামিয়ে গেল তখন ঘড়ির কাঁটা ৯.০০ টা পেরিয়ে গিয়েছিল। অনলাইন বুকিং দেখাতেই রিসিপশানে দুই নারী একসাথে সম্ভাষণ জানাল। যার মধ্যে একজন ছিল হিজাব পরিধান করা, অন্যজন অত্যাধিক ওজনওয়ালা। রেজিষ্ট্রেশন ফরমে সাইন করতে করতেই আশপাশের সম্ভাব্য গন্তব্য সম্পর্কে জানতে চাইলাম। বেস্ট অপশনটি বেছে নিয়ে যখন জানলাম মাত্র ২০ মিনিট পরে গাড়ি এসে নিয়ে যাবে হোটেলের সামনে থেকে, তাড়াতাড়ি ব্যাগ রেখে শাওয়ার নেওয়ার জন্য রুমের দিকে যাওয়ার আর্জি জানালাম। মোটা মেয়েটি নিজে উঠে এসে বাইরে অপেক্ষমান টুকটুকের ড্রাইভিং সিটে উঠে স্টার্ট দিল বিস্ময়াভিভূত আমাকে পেসেঞ্জার হিসেবে নিয়ে। 

মিনিট খানেকের মধ্যে ঘন জঙ্গলে ঘেরা, পানিতে অ্যাকুরিয়াম বানানো এক ব্রীজের অপর পাড়ের  অনেকগুলো রুমের একটিতে নিয়ে নিজে রুম খুলে সবকিছু বুঝিয়ে দিল হাসিমুখে৷ আমি বুলেট গতিতে শাওয়ার সেরে রুম থেকে বেরিয়েই দেখি রুমের দরজায় এক বিড়াল বসে আছে চুপ করে৷ বিড়াল কোথা থেকে আসল খুঁজতে আশেপাশে থাকাতেই পাশের রুমের সামনের চেয়ার আর টি টেবিলে আরো ৪টি বিড়াল সহ এক শ্বেতাঙ্গিনী রমণি দেখি আমার দিকে চেয়ে মিষ্টি হেসে বলল, গুড মর্ণিং।

এক নিঃশ্বাসে তার পরিচয় জেনে নিয়ে যখন কথায় মজে যাচ্ছিলাম, আমার বন্ধ রুমের টেলিফোন বেজে উঠায় বুঝলাম আর দেরী করা যাবে না, নিশ্চয় ট্যুর অপারেটর চলে এসেছেন। 

শ্বেতাঙ্গিনী আর তার বিড়ালের মায়া মাড়িয়ে ছুটে চললাম জেটির দিকে। গন্তব্য ফোর আইল্যান্ড।

সারাদিনের জন্য আমরা চষে বেড়াব চারটি দ্বীপে। দুপুরে বসে খাব কোন একটি আইল্যান্ডের সাদা বালির সৈকতে। মূলত এটি আন্দামান সাগর৷ যার প্রতিটি ফোঁটা পানিই একদম নীল। এমন স্বচ্ছ পানি আমাদের সেইন্ট মার্টিনের ছেঁড়া দ্বীপের পূর্ব পাশে কিছুটা দেখা যায়। 

জেটিতে ১৬ জনের টিমের অন্যদের সাথে পরিচয় হতে গিয়ে বুঝলাম আমিই একমাত্র বাংলাদেশী। দুইজন ভারতীয় রমনী৷ বাকিরা সবাই শ্বেতাঙ্গ এবং কোরিয়ান। 

ভারতীয়দের সাথে অটোমেটিক সখ্যতা হয়ে গেল। তারা কেরালার বাসিন্দা যদিও একজন বাহরাইনের গার্মেন্টসে জব করেন, অন্যজন কেরালার ডাক্তার।  দুই বান্ধবী ছুটি ম্যানেজ করে তিনদিনের ছুটিতে ক্রেবি এসেছেন। 

বৃষ্টির কারণে সাগর উত্তাল। এর মাঝেই এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে বিশেষভাবে নির্মিত চৌকা মাথাওয়ালা এবং ইয়া লম্বা লগুই লাগানো বিশাল ইঞ্জিনের বোটগুলো রোমাঞ্চ আর উত্তেজনা ছড়িয়ে চলছিল। আমরা লাইফ জ্যাকেটের সাথে বিশেষ প্লাস্টিকের প্যাকেটে মোবাইল আর প্রয়োজনীয় জিনিস সংরক্ষণ করে বৃষ্টিবিলাস করছিলাম প্রচন্ড ঢেউয়ের তালে তালে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ রেখে। 

দুপুরের খাওয়ার জন্য একটি বিশেষ অনুমতি প্রাপ্ত দ্বীপে গেলাম। যেখানে শুধু দিনের সময়ে লোক থাকতে পারে, সংরক্ষিত বনাঞ্চল বলে৷ এখানেই প্রকৃতির ক্ষতি না করে রান্নাবান্না করে আগে থেকে অর্ডার করা খাবার পর্যটকদের জন্য রেডি রাখা হয়। আমাদের মত আরো বহু পর্যটকবাহী নৌকা থেকে কয়েক শ মানুষ নেমেছে, যাদের বেশিরভাগ শ্বেতাঙ্গ।  পরে জেনেছিলাম, থাইল্যান্ডের সব প্রদেশগুলোই পশ্চিমা পর্যটকদের জন্য স্বর্গরাজ্য।  বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে এদের আনাগোনা বেশি। 

নীল জলে ভেসে ভেসে ভারতীয় রমণীদের সাথে স্নোরকেলিং, সি ঝাম্পিং, আড্ডা, দৌড়াদৌড়ি, খুঁনসুটিতে সময়টা কখন পার হয়ে গেল বুঝে উঠার আগেই যে যার হোটেলের সামনে বিদায় নিলাম অত্যন্ত দুঃখিত হৃদয়ে।

সেই ভোর ৪টা থেকে একজন ড্রাইভার আর একজন গাইড ছাড়া বাকি  সর্ব মূহুর্ত নারীদের সাথেই কথা বলেছি এই কথা মনে পড়তেই আঁতকে  উঠে প্রতিজ্ঞা করলাম- No more today talk with any women. এই কথা ভাবতে ভাবতে হোটেলের রিসিপশনে পা দিতেই সকালের হিজাব পরা মেয়েটা রিনিঝিনি কন্ঠে বলল, তোমার যদি আপত্তি না থাকে আমি তোমার সাথে কিছু কথা বলতে চাই। আধা ঘন্টা পরে আমার ডিউটি শেষ, তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো।

ভয়ে আমার শরীর হিম হয়ে এলো। না জানি কোন বিপদে পড়লাম। নানা ধরণের দোয়া দরুদ পড়তে পড়তে রুমে যখন হিট ওয়াটেরর নীচে দাঁড়িয়েছি শাওয়ারের জন্য, তাতেও ভয়ে গা কেঁপে যাচ্ছিল সমানতালে।

তারপরেও ফ্রেশ হয়ে এসে যখন রমনীর সামনে এলাম, সে স্মিত এসে আমাকে বলল, চল ভাই।

বুক থেকে পাথর নেমে গেল যেন। যে নারী ভাই ডাকতে পারে সে নারী আমার ক্ষতি কখনো করবে না, এই বিশ্বাস নিয়ে তার স্কুটির পেছনে উড়ে যেতে যেতে নগর ছেড়ে আবাসিক অঞ্চলের দিকে চললাম।

বুঝতে পারলাম আগেই সে জানিয়েছে আমি আসব। সে তার মায়ের পরিবারে আমাকে নিয়ে এসেছে। নারীটি সদ্য বিবাহিত। স্বামীও একটি হোটেলের ম্যানেজার। দুইজনের নতুন সংসার। আর এখানে বাবা-এক ছোট ভাই-আর এক ছোট বোন, বাবা নেই। মালেয়শিয়ান বংশদ্ভূত এই পরিবারের মত বহু পরিবারের সাথে মালেয়শিয়া-থাইল্যান্ড-ইন্দোনেশিয়া-লাওস এবং ব্রুনাই এর মধ্যে আত্ময়ীতা হয় বলে সব চেহারার অনেককেই এই বেল্টে দেখা যায়।

ছোট বোনটি সদ্য গ্রাজুয়েশন শেষ করেছে। মালেশিয়ান চেহারা্র অত্যাধিক ওজ্জ্বল্যসম্পন্ন অসম্ভব রূপবতী মেয়েটি আমাদেরকে খাবার পরিবেশন করছিল হাসি মুখে। সান্ধ্যকালীন স্ন্যাক্সসের সাথে আলাপচারিতার এক পর্যায়ে আমার একলা ভ্রমণের ফিরিস্তি শুনে বড় বোন যা বলল তার সারমর্ম হচ্ছে, আমাকে তাদের অত্যন্ত পছন্দ হয়েছে। বাংলাদেশের সাথে তাদের আত্মীয়তা করতে কোন সমস্যা নাই। যদি আমি রাজি থাকি তার ছোটবোনকে আমার হাতে শরীয়ত মোতাবেক বিয়ে দিতে ইচ্ছুক।

সাথে সাথেই স্থানীয় নরম নরম নুডুলসগুলো গলায় আটকে এমন অবস্থা আমার, যেন আটকে মরে যাব। তাড়াতাড়ি পানি খেতয়ে সুস্থির হওয়ার পর বিনীতভাবে জানালাম, আমি রাতে একটু চিন্তা করি। পরিবারের সাথে আলাপ করে সকালে মতামত জানাব।

সেই সকাল আর আসে নি। ভোরের সূর্য উদিত হওয়ার মূহুর্তেই ব্যাকপ্যাক কাঁধে নিয়ে আন্দামান সাগরে নেমে পড়লাম পরবর্তী ডেস্টিনেশন পি পি আইল্যান্ডের (Phi Phi Island) উদ্দেশ্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *