বাংলাদেশি রাজনীতিবিদদের রাজনৈতিক দৈন্যতা

ধর্মীয় দৃষ্টি কোণ হতে চিন্থা করলে ব্যাপারটা মিথ্যা। কিন্তু বাঙালী জাতির প্রক্ষিতে কথাটা বাস্তব সত্য। বিজ্ঞানী ডারউইন প্রমাণ করে দেখিয়েছেন বানরের বিবর্তনের ফলে মানুষের আবির্ভাব। চেহারা সুরত বা কথাবার্তায় বানরের অনুরূপ না হতে পারে, খাছলত বা স্বভাবে বাঙালি জাতি অবিকল বানরের ন্যায়। একটা বানর যখন গাছের উপরের ডালে উঠতে চায়, আরেক বানর তখন লেজ ধরে টেনে ধরে রাখে, যাতে উপরে উঠতে না পারে। আমরা বাঙালিরাও অবিকল বানরের মতন। একজন বাঙালি যদি নিজের মেধা, মনন, স্বকীয়তা, যোগ্যতা দিয়ে তাবৎ পৃথিবীর র‍্যাংকিং এ উপর দিকে উঠতে চায়, তবে আরেকদল স্বজাতি তাঁকে যেভাবেই পারুক না কেন, টেনে নিচে নামাবেই। বেশি দূরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই, নোবেল বিজয়ী ডঃ ইউনুস একজন উচ্চমানের পরিষ্কার উদাহরন, যদিও অনেকে ডঃ ইউনুস সাহেবকে ‘সুদখোর’ ‘গরীবের রক্তচোষা’ বলে থাকেন, যা আপেক্ষিক অথবা কু-সমালোচনার দাবীদার। কিন্তু এই অপপ্রচার, অসুস্থ প্রতিযোগিতা, সম্মানহানী অথবা টানাহেঁচড়াতে আমরা, আপনারা, ভিন্ন জাতিরা এই কি ম্যাসেজ পাচ্ছে বুঝতে পারছেন?

যে যার অবস্থান থেকে সুবিধাবাদী। রিকসায় যে চড়ে সে বাস, ট্রাক, কারের দোষ খোঁজে। একই মানুষ বাসে চড়লে রিকশাওয়ালাকে ঝাড়ি মারে। সেই লোক প্রাইভেটকারে চড়লে দুনিয়া নিজের মনে করে। যার অর্থ দাঁড়ায়, কেউ কাউকে সাইট দিতে চায় না। আগে আমি পাব, পরে তোমারটা দেখা যাবে।

বাংলাদেশকে সবাই সোনার বাংলা বানানোর মন্ত্রে উজ্জ্বীবিত। কিন্তু আদতেই কি পূর্ব হতেই আমাদের বাংলা সোনার বাংলা নয়? যদি তাই নয় হতো, তবে কেন সেই বৃটিশ আমল হতেই বঙ্গকে চুষে চুষে নারকেলের চোবড়া বানিয়ে ফেলছে? স্বাধীনতার পর হতে যারাই মসনদে ছিলেন, ব্যাক্তি শাসক ছাড়া প্রত্যেকের শাসক পর্ষদ, পরিবারবর্গ, আত্নীয়স্বজন এবং সমর্থকগণ দূর্নীতির সাথে জড়িত থেকে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন। সুতরাং, যারাই ক্ষমতার স্বাদ পায়, তারাই খায়। কোত্থেকে খায়? সোজা কথা- আমার আপনার সোনার বাংলা থেকেই খায়। বাংলার যদি নাই থাকত, তবে ইংরেজরা পর্যন্ত লোভের হাত থেকে বাঁচতে পারল না কেন? সুতরাং বাংলা- আল্লাহ প্রদত্তই সোনার বাংলা। এত উর্বর মাটি পৃথিবীতে বিরল। সোনার বাংলার সোনার মাটি।

অথচ মাটি উর্বর হলেও সোনার বাংলার বেশিরভাগ মানুষ সোনা নয়, বিশেষ করে যারা দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পান। সৎ, প্রজ্ঞাবান, দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক হাতেগোনা; বাকিরা চোর, বাটপার, ক্ষমতালিপ্সু, পেশীশক্তির কাঙাল এবং বিবেকহীন। যাদের কারনেই দেশের উন্নয়ন হয়না, ভবিষ্যৎ  উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয় না, বিশ্ব দরবারের সাথে যোগাযোগে সাফল্য পাওয়া যায় না।

আসুন আমরা গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে রাজনীতি এবং রাজনীতিবিদদের গুণাবলী সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করি।

গণতন্ত্রের নূন্যতম সংজ্ঞা বলতে বুঝায় ‘প্রতিযোগিতা’ বা গণতন্ত্রের বিখ্যাত তাত্ত্বিক রবার্ট ডল যেটাকে বলেছিলেন, ‘কনটেসটেসন ওপেন টু পার্টিসিপেসন’ বা যাকে বলা যায়, অংশগ্রহণমূলক প্রতিযোগিতা।

রাজনীতি যারা করেন সাধারণত তারা এলিট শ্রেণী হয়ে থাকেন। সুতরাং গণতন্ত্রের মন্ত্রবলে তাদেরকেও একটা নির্দিষ্ট নিয়ম অনুযায়ী রাজনীতিতে প্রবেশ করতে হয়। কমবেশি সবাইকে অন্তত শিষ্টাচার অর্জন করে রাজনীতিতে প্রবেশ আরাধনাযোগ্য।

অথচ আমাদের দেশের রাজনীতিবিদগণের রাজনীতি বর্তমানে অসুস্থ। রাজনীতি যারা করেন তাদের মধ্যে যদি ইতিবাচক শিষ্টাচার থাকত, আমাদের দেশ আজ সংকটের খাদের কিনারে দাঁড়াত না। রাজনীতিবিদরা যদি নিজেদের মধ্যে কামড়াকামড়ি না শিখাতেন, তবে মানুষের বিবেক এত পঁচে যেত না। নিজেদের মধ্যে যদি ঐক্য, ভালোবাসা, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকত, তবে সীমান্তের কাঁটাতারে বহিঃরাষ্ট্র ফেলানীকে হত্যা করে ঝুলিয়ে রাখতে পারত না।

পুলিশের দলীয়করণ, এলিট গোষ্ঠীর নিজেদের মধ্যে রাজনৈতিক আন্তঃসম্পর্ক বছরের পর বছর ধরে অনুদার প্রক্রিয়ার ভেতর আটকে রাখা, নিন্ম আদালতের কার্যক্রম দলনিরেপেক্ষ হওয়ার সুযোগ না পাওয়া এবং বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য অনুযায়ী, উচ্চ আদালতেরও নির্দিষ্ট কার্যক্রম (যেগুলো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্ট) অনেক ক্ষেত্রে দলীয় প্রভাবমুক্ত না হতে পারাটা এসব রাজনৈতিক এলিটদের মধ্যে আইনের শাসনের প্রতি দৃঢ অঙ্গীকার জন্মানোর ইঙ্গিত বহন করে না। গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে, এমনকি রাজনৈতিক এলিটদের মাঝেও, আইনের শাসনের বদলে যেটা সৃষ্ট হয়েছে এবং কার্যত যা সংহত রূপ ধারন করেছে তা হলো, আইনের শাসন নয়, বরং আইন দ্বারা শাসন (রুল বাই ল)। বাংলাদেশে লক্ষ করবেন, প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল (মূলত আওয়ামীলীগ ও বিএনপি) গোটা সমাজ এমনকি রাষ্ট্র সংগঠনের ওপরও প্রায় একচ্ছত্র আধিপত্য এবং ভাবাধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে। সে অনুযায়ী এ দেশের সীমাবদ্ধ প্রবেশাধিকার-ব্যবস্থাটির গতময়তার একটা গুরুত্ত্বপূর্ণ নিয়ামক হচ্ছে দলতন্ত্র। এ দেশের নাগরিকত্ব ও তার সামষ্টিক উদ্যেগের গতিময়তার ভেতরেও দারুনভাবে দলতন্ত্রের গভীরতর প্রভাব লক্ষণীয়।

সুতরাং দলতন্ত্র, সংকটময়তা সর্বোপরী রাজনৈতিক দৈন্যদশা কাটানো প্রয়োজন। কিভাবে এই উন্নয়ন সম্ভব? এটা আমরা শিখতে পারি সমাজবিজ্ঞানী বা দার্শনিক ইয়োশিহিরো ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামার কাছ থেকে। ফুকুইয়ামা তাঁর সাম্প্রতিক কালে প্রকাশিত গ্রন্থ অরিজিনস অব পলিটিক্যাল অর্ডার-এ ২০১১ রাজনৈতিক উন্নয়ন বলতে বুঝিয়েছেন তিনটি দিকের মধ্যে স্থিতিশীল ভারসাম্য অর্জনকে। এগুলো হচ্ছে যথাক্রমে রাষ্ট্রনির্মাণ (ষ্টেট বিল্ডিং), আইনের শাসনের সুসংহতকরণ (কনসলিডেশন অব রুল অব ল) এবং গণতন্ত্রে উত্তরণ (ডেমোক্রেটিক ট্রানজিশন)।

অর্থ্যাৎ রাজনৈতিক উন্নয়ন বাংলাদেশে ঘটাতে হলে আমাদের রাষ্ট্রের বর্তমান সীমাবদ্ধ প্রবেশাধিকার ব্যবস্থা থেকে ক্রমান্বয়ে উন্মুক্ত প্রবেশাধিকার ব্যবস্থার দিকে এগোতে হবে। নিজের দেশপ্রেম, সমাজপ্রেম, বিবেক এবং মনুষ্যত্বকে আগলে রাখতে হবে। সুবিধাবাদীতা পরিত্যাগ বাঞ্চনীয়। আইনকে নিজস্ব গতিতে চলতে দেওয়া বাধ্যতামূলক। সমাজের সর্বস্থরের জন্য আইনের সম ব্যবহার। এবং একই সাথে রাষ্ট্রের বৃহৎ উন্নয়ন পরিকল্পনা সততার সাথে বাস্তবায়ন।

সামনে জাতীয় নির্বাচন আসন্ন। গণতন্ত্রের সাম্যবস্থা বজার রাখার স্বার্থে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরী করে সর্ব দলীয় নির্বাচন প্রণয়ন সকল জনগণের ইপ্সিত লক্ষ্য। নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে সে নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। বাঙালী অতি নাটকীয়তা পছন্দ করে, তাই বলে ভড়ং নয়। অতীত অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতার কারণে মানুষকে বিশ্বাস করতে ভয় পাওয়া রোগ পিস্টানথ্রোফোবিয়া দূর করা জরুরী। মনে রাখতে হবে রাজার দোষে প্রজা কষ্ট পায়। নদী শুকিয়ে গেলেও দাগ থেকে যায়। দাগ বড় খারাপ জিনিস। দাগ থেকেই দাগী হয়। তাই জনমতের গুরুত্ব দেওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলে আশা করি, Free and fair নির্বাচনের জন্য যা একান্তই প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে Mutual-Conversation এর বিকল্প নেই।

ভোটার সাধারণত দু’ধরনের হয়ে থাকেন। পার্টি ভোটার এবং ফ্লোটিং ভোটার। আমাদের দেশে বেশির ভাগই পার্টি ভোটার। রাজনীতিবিদদের অঙ্গীকার, বাস্তবায়ন, ক্ষমতার ব্যবহার, দূরদর্শীতা এবং কর্মদক্ষতা এসব ভোটারকে মোটিভেট করে।

নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দল, প্রার্থীর সাথে সাথে ভোটাররাও নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন মানসিকভাবে। একটা কথা প্রচলিত আছে। জনগণ এবং ভোটারদের মধ্যে পার্থক্য কি? উত্তর এরকম- ভোটাররাও জনগণ, তবে একবার ব্যবহার্য। আশা করতে দ্বিধা নেই, এমন বিশ্বাস রাজনীতিবিদ্গণ সার্ফ এক্সেল দিয়ে ধুয়ে মুছে সাফ করে নিবেন।

শেষ করব নিচের উদ্ধৃতিটি দিয়ে। আশা করি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের, রাজনৈতিক দৈন্যদশা কাটিয়ে রাজনৈতিক উন্নয়নের মন্ত্রের মত কাজ করবে, যদি মনে প্রাণে তা বিশ্বাস করেন।

স্পেনে গণতন্ত্রের প্রারম্ভে পার্লামেন্টে বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী এডলফো সুয়ারেজ গণতন্ত্রে জনগণের ভূমিকার কথা বলতে গিয়ে বলেছিলেন

‘’The future is not written because only the people can write it.’’

‘’Prezworski ‘1991 থেকে উদ্ধৃত’’।

সবাই ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন, সৃষ্টিকর্তার উপর আস্থা রাখুন।

তথ্যসূত্র- প্রতিচিন্থা, সেপ্টেম্বর’ ১৩

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *