ট্রাভেল উইথ মুরিদ-এ-ইবনে বতুতা (প্যারিসের পাতালপুরীতে)

মেয়েটা সুন্দর। কৃষাঙ্গ মেয়েদের মধ্যে এমন আকর্ষণীয় মেয়ে কম দেখা যায়। বাঁকানো নাক। সুন্দর চুল। অবশ্য এট্রাকশনের প্রধান কারণ, সম্ভবত মেয়েটার হাইট। বসে থাকা অবস্থায়ও মনে হচ্ছে ঝাড়া ৬ ফিট লম্বা হবে। লম্বা ও মোটা মেয়েদের প্রতি আকর্ষণ সেই কৈশোর থেকে। মেয়েটা আমার তিন সিট সামনে আড়াআড়ি বসেছে। সে আমাকে খেয়াল করেনি। আমিই সোনা পরীক্ষার মত এতক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছি। মেট্রো থামতেই মেয়েটা উঠে দাঁড়াল। আমার ধারণা ঠিক। অনেক লম্বা। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে আমার সাথে চোখাচোখি হল। আমি ঠোঁটের কোণে স্মিত একটা হাসি ঝুলিয়ে দিলাম জেমস বন্ডের মত। মেয়েটা এক নাগাড়ে আমার দিকে চেয়ে চেয়ে মেট্রো থেকে নেমে গেল। আমাকে আর পায় কে! হাজার হলেও বাঙালি। আমার দিকে চেয়ে দেখছে মানে পটে গেছে। ভাবলাম, পেছন পেছন যাব নাকি? ততক্ষণে মেট্রো আবার ছেড়ে দিয়েছে। আমার আর ঐ রমণীর এই লুকোচুরি লুকোচুরি গল্প আর কেউ খেয়াল করেছে দেখার জন্য পেছনে ফিরে তাকাতেই ধ্বক করে উঠল বুকটা। সামনেও চাইলাম। একই অবস্থা। ঝট করে উঠে দাঁড়ালাম। সামনে পেছনে মেট্রোর বগিতে আমি ছাড়া কেউ নেই। নেই মানে নেই। তার উপর চলতে চলতে বগিগুলো আলাদা আলাদা দরজা বন্ধ হয়ে গেল। আরেকটু ভড়কে গেলাম। ভড়কে যেতাম না, যদি মোবাইলে চার্জ থাকতো। মাত্র ৪% চার্জ ছিল, যে কোন সময় অফ হয়ে যাবে। সবচেয়ে বড় কথা, প্যারিসের মেট্রো লাইন অনেক পুরোনো। আর মাটির অনেক নীচে। প্রায় ১১৮ ফিট গভীরে। যাই হোক- ভাবলাম, হয়তো পরের স্টেশনে গিয়ে থামবে। আশার কথা, বগির জানালা খোলা যায়। বাতাস আসে। রাতটুকু যদি কাটাতে হয় এখানে, অন্তত অক্সিজেনের অভাবে মরার সম্ভাবনা নাই। কিন্তু না। ট্রেন অন্য এক পথে গিয়ে দূরে দূরে অল্প পাওয়ারের লাইটওয়ালা অন্ধকার এক জায়গায় গিয়ে থেমে গেল। পাশের লাইনে আরেকটা মেট্রো। সেটাও দাঁড়ানো। উপয়ান্তর না দেখে বিসমিল্লাহ বলে ইমার্জেন্সি সুইচটা টান দিয়ে উপরে তুলে দিলাম। মিনিট ১০ পরেই এক আদমের দেখা পেলাম বহুদূরের বগির চাবি দিয়ে দরজা খোলে খোলে আসছে। আমার কাছে আসতেই ঘটনা বললাম। আমি ভুলে নামি নি এবং আমি জানি না এই ট্রেন আর যাবে না। সে বলল, কোন টেনশান নিয়েন না ফ্রেন্ড। আমার শিফটিং শেষ। জাস্ট ১৫ মিনিট সময় দাও। চেক করে রেডি হলে আবার চলবে। তুমি বসে থাক। তারপর ইমার্জেন্সি লকটা চাবি দিয়ে অফ করে দিল না হয় ট্রেন স্টার্ট হবে না। আল্লাহর অসীম রহমত আর মা বাবার দোয়ায়, ট্রেন চালু হয়ে গেল কিছুক্ষণ পরেই। স্টেশনে আসতেই লাফ দিয়ে নামলাম। পরেরবার আর কোন মেয়ের রূপে অবশ হচ্ছি না, শিউর। দৌড়ে ড্রাইভার কম্পার্টমেন্টের দিকে গেলাম। ততক্ষণে আগের অপারেটর চেঞ্জ হয়ে নতুন একজন এসেছে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আগের জন কই। সে কেন জিজ্ঞেস করাতে ঘটনা ঘুলে বলে ধন্যবাদ জানাতে আসার কথা বললাম। সে আমি কোন স্টেশনে যাব জিজ্ঞেস করতে বললাম- gare de l’est, সে বলল আমার সাথে উঠে আয়। প্রথমে বিশ্বাস না করলেও উঠার পর সত্যি মনে হল। প্যারিসে পা রাখতে না রাখতেই মেট্রো চালকের আসনে! তার নাম জুলিয়ান। অরিজিন ফ্রান্সের৷ আমাকে বসার জন্য কো-অপারেটরের চেয়ার নামিয়ে দিল। এর পর তার সাথে আড্ডা শুরু। এত দারুণ মানুষ সে। তারও দুটি বাচ্চা। একটা ছেলে, একটা মেয়ে। একটাই শর্ত, স্টেশনে আসলে যেন আমি ভিডিও বা ছবি না তুলি। তাতে ক্যামেরা ডিকেক্ট হবে। পরের ১৬ মিনিট সে আমাকে কিভাবে মেট্রো অপারেট করতে হয় শিখিয়ে দিল। কিভাবে বাঁক ঘুরে, কিভাবে একই স্টেশনের বামে যাবে না ডানে যাবে, কত স্পীডে চালাতে হবে- সব। আমি মুগ্ধ। সে বলল, সারারাত তার ডিউটি আছে। চাইলে আমি তার সাথে শিখতে পারি। যেহেতু সকালে চলে যাব, গতকাল রাতেও এয়ারপোর্টে ঘুমিয়েছি, তাই ইচ্ছা থাকা সত্বেও না করলাম। একেই বলে, চাইলাম জল পাইলাম শরবত। নারী নিয়ে গেল মৃত্যুকূপে, দিয়ে গেল জনমের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিজ্ঞতা। বলি কি, রিস্ক ছাড়া রোমাঞ্চ নাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *