আমাদের পিতৃতুল্য শিক্ষক মহোদয়গণ

আমরা মানব সন্তান। যাদেরকে সৃষ্টিকর্তা সমস্ত জীবজগতের চেয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে ঘোষণা করেছেন। জাগতিক  অন্য সকল প্রাণের সাথে মানুষের মূল পার্থক্য একটি স্থানে, ‘বিবেক’।

খেয়াল করে দেখুন, আমি বলেছি, ‘আমরা মানব সন্তান’। আমি বলি নি, আমরা মানুষ। কারণ, মানব এবং মানুষের মাঝে একটি অদৃশ্যমান পার্থক্য বিদ্যমান।

প্রজন্মের পর প্রজন্ম হাত, পা, নাক, মুখ, চোখ সহ আনুষাঙ্গিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে জন্মালেই সে মানব সন্তান হিসেবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। কিন্তু মানুষ হতে হলে শুধুমাত্র অঙ্গপ্রত্যঙ্গই যথেষ্ট নয়, এর সাথে মানষের মত মানুষ হওয়া, তথা বিবেক নামক অদৃশ্যমান সফটওয়্যার এর পজেটিভ কার্যকরণ দরকার।

সেক্ষেত্রে বলা যায়, নীতি-নৈতিকতা, আদর্শ, ভাল-মন্দ, আচার-ব্যবহার নামক সফটওয়্যারের শিক্ষা মানুষ লব্দ করে থাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ারে

খেয়াল করে দেখুন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একটি অবকাঠামো মাত্র, এর মূল স্তম্ভ আমাদের সম্মানিত ‘শিক্ষকগণ’।

বলা হয়ে থাকে, প্রতিটি শিক্ষক, একেকজন মানুষ গড়ার কারিগর।

আমরা যখন শিক্ষলয়ে প্রবেশ করি, আমাদের অবয়ব থাকে এক প্রকার বীজের মত। আল্লামা জালাল উদ্দিন রুমী বলেন,

‘’মাটতে বীজ বুনলে বৃক্ষের জন্ম দেখোনি?
আমিও মানববীজ, বুঝতো পারো না?’’

একটি শস্যদানা তথা বীজকে যখন মাটে রোপণ করা হয়, আপাতদৃষ্টিতে সেটিকে কবর দেওয়ার নামান্তর। মনে হবে যার কবর হয়ে গিয়েছে, সে তো শেষ!

কিন্তু, না! যখন আমি বীজের মুখ বন্ধ করে দিলাম, তখনই বীজের প্রাণের সঞ্চার শুরু! যেখানে মাটি রূপক অর্থে শিক্ষালয়, আলো-বাতাস-পানি শিক্ষক। এই উপাদান সমূহের তারতম্যের উপর বীজের উত্থান-পতন নির্ভর করে।

ঠিক একইভাবে আমাদের নিজেদেরকেও যখন আমরা মানববীজ কল্পনা করি, আমরা একটি শিক্ষালয়ে যখন প্রবেশ করি, ঠিক যেন আমাদেরকে কবরে আবৃত করা হল। আমরা নানা ধরণের বাহ্যিক অপকর্ম থেকে নিজেদের দূরে রেখে শিক্ষার স্বরুপ উন্মোচনে নিজেদের নিয়োজিত করি। লক্ষ্যনীয়, মানব বীজের আলো-বাতাস-পানি উপাদান আমাদের শিক্ষকগণ।

আমাদের যাই শেখাবেন, আমরা তাই শিখি। সুতরাং, শিক্ষকগণ একেকজন মানুষগড়ার কারিগর, সম্পূর্ণ অর্থে শতভাগ সঠিক।

এখন আসুন, আমরা সমার্থক বিষয়ের উপর আলোকপাত করি। শিক্ষকগণ আমাদের নীতি-নৈতিকতা, সামাজিকতা, দায়বদ্ধতার শিক্ষা দেন। প্রশ্ন হল, সেই শিক্ষকের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা বা আচার-আচরণ, ব্যবহার কেমন হওয়া উচিত?

এটি একটি সিম্পল প্রশ্ন। কারণ, প্রায় প্রতিটি শিক্ষার্থী অতি অল্প বয়সেই এই উত্তর আত্নস্থ করে বড় হতে থাকে। আমরা প্রায় প্রতিজনই একটি কবিতা পড়েছি। কবিতার নাম, ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ লিখেছেন, কাজী কাদের নেওয়াজ।

এটি শুধু একটি কবিতাই নয়, একটি সম্পূর্ণ জীবনের দিক-নির্দেশিকার মূলপাঠ। আপনি আপনার শিক্ষকের প্রতি কেমন ব্যবহার করবেন, আপনার শিক্ষক আপনার কতটুকু নমঃতূল্য, আপনার শিক্ষকের আপনার প্রতি কতটুকু অধিকারবোধ কাজ করে, পরিষ্কার অক্ষরে বিন্যস্ত করা হয়ে হয়েছে প্রতিটি লাইনে লাইনে। শেষ প্যারাতে বলা হয়েছে,

‘’উচ্ছ্বাস ভরে শিক্ষকে আজি দাঁড়ায়ে সগৌরবে

কুর্ণিশ করি বাদশাহে তবে কহেন উচ্চরবে

আজ হতে চির উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির

সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ আলমগীর

আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে মনে করি বিএসপিআই’তে আমার অধ্যয়ন। যদি, মানব সন্তান হিসেবে মানুষের মত মানুষ হওয়ার ১০০ সিঁড়িতে ১ টি সিঁড়িতেও উঠতে পেরেছি বলে মনে করি, এর সম্পূর্ণ কৃতিত্ব বিএসপিআই এর শিক্ষকদের অবদান।

আমি ৪১ তম ব্যাচের শিক্ষার্থী, ২০০৬ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ছিল আমাদের বিচরণ।

আমরা যারা সুইডিশের শিক্ষার্থী, আমরা সকলেই জানি, সুইডিশ শুধুমাত্র একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, সুইডিশ একটি পরিবার।

পরিবারে সুখ-দুঃখ-হাসি-কান্না যেমন থাকে, সুইডিশেও অবিকল একই আস্বাদন পাওয়া যায়।

এটি শুধু মাত্র একটি কারণে হয়ে উঠে নি। আমি মনে করি, ভৌগলিক অবস্থান, অবকাঠামোগত বিন্যাস এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ এর জন্য উপযুক্ত কারণ।

সুইডিশ এমন একটি স্থানে অবস্থিত, যাকে আমি তুলনা করতাম, সবুজ মরুভূমি নামে। সবুজ অথচ হাহাকার। অল্প স্থান, অল্প বিনোদন, অল্প সুযোগ-সুবিধা, স্বল্প মানুষ। ফলে সবার সাথে সবার একটি অবিচ্ছেদ্য বন্ধন না চাইলেও প্রাকৃতিকভাবেই গড়ে উঠে।

আমাদের শিক্ষালয়টি তৈরী করেছিলেন, সুইডেন সরকারের প্রতিনিধিরা। তাঁদের অবকাঠামোগত বিন্যাস এত চমৎকার এবং আন্তরিক পরিবেশে করা হয়েছে, যেখানে শিক্ষররা চাইলেও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে দূরে থাকতে পারবেন না, আবার শিক্ষার্থীরা চাইলেও শিক্ষকদের কাছ থেকে পালাতে পারবে না।

প্রকৃতির এক অসাধারণ দান, কাপ্তাই। আমরা জানি, প্রকৃতিই মানুষের বড় শিক্ষক। সবুজ, পাহাড়, নদী, জোছনা, চাঁদ থেকে যে শিক্ষা একজন মানুষ পাবে, তা বর্ণনাতীত এবং সে শিক্ষার শুদ্ধতা সম্পর্কে সন্দেহ আনাও অবান্তর।

এই সমস্ত কারণেই আমাদের শিক্ষক মহোদয়গণকে আমরা পেয়েছি আমাদের পিতার স্থলে। একজন পিতা সন্তানের সকল ভাল-মন্দের যেমন দায়ভার গ্রহণ করেন, আমাদের শিক্ষকগণ আমাদের সমস্ত ভাল-মন্দের দায়ভার স্কন্ধে নিয়েছিলেন।

একরাতের ঘটনা, আমরা তখন ফার্স্ট ইয়ারে মাত্র ভর্তি হয়েছি। জাহাঙ্গীর ছাত্রাবাসের নীচ তলায় তৃতীয় বর্ষের সাথে চতুর্থ বর্ষের কি নিয়ে যেন ঝগড়াঝাঁটি হচ্ছে। তখনকার হোস্টেল সুপার ছিলেন, কম্পিউটার বিভাগের জনাব জাবেদ ইকবাল। চেঁচামেচি শুনে তিনি প্রায় কাঁচা ঘুম থেকে সেই মধ্যরাতে দৌঁড়ে এলেন এমন এক সময়ে, যখন ৪র্থ বর্ষের একজন ছাত্র ৩য় বর্ষের একজন ছাত্রকে মারতে উদ্যত হয়েছিল। স্যার সেই ৩য় বর্ষের ছাত্রের সামনে দু হাত দু দিকে দিয়ে বললেন, ‘’ওকে মারার আগে, আমাকে মারতে হবে। আর আমি যতক্ষণ শিক্ষক হিসেবে এই প্রতিষ্ঠানে আছি, আমার কথার উপরে কেউ কথা বলতে পারবে না, যদি আমি অন্যায় বিচার করি, তবে তোমরা যাই বলবা, আমি মাথা পেতে নেব’’।

দূরে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছি! স্যারের এই বাক্য শুনে সকলের মেজাজ বরফের মত গলে গেল, যে যার মত মাথা নীচু করে রুমে ঢুকে গেল।

পরদিন বিচার হল, সন্ধ্যায় দেখা গেল মারতে যাওয়া ৪র্থ বর্ষের বড় ভাই এবং মার খেতে যাওয়া ৩য় বর্ষের ছোট ভাই কাঁধে হাত দিয়ে গলাগলি করি কাসেম কাকার হোটেলে বৈকালিক নাস্তা করতে যাচ্ছেন!

সেই সময়ে আমরা আমাদের পিতৃতুল্য অনেক জন সম্মানিত শিক্ষকদের আন্তরিক সাহচার্য্য পেয়েছি।

আমরা পেয়েছি, সর্ব জনাব নিজাম উদ্দিন স্যার (যাকে আড়ালে আমরা পেন্সিল স্যার ডাকতাম কারণ স্যার ছিলেন অত্যন্ত শুকনো), তাজ উদ্দিন স্যার (স্যারকে ডাকতাম পাংখা স্যার, তিনি খুব বেশি স্মার্ট চলাফেরা করতেন), আবদুল মতিন হাওলাদার (এই স্যারকে সবাই আর্মি স্যার নামেই ডাকে, কারণ স্যারের বাহ্যিক লুকটা অনেকটা সৈনিকদের মত), মুজিবুর রহমান চৌধুরী (এই স্যারকে সবাই যমের মত ভয় পেত, কারণ স্যার পথের মধ্যেই পড়া জিজ্ঞেস করতেন), ফারুক আহমেদ (চির তরুণ নামেই পরিচিত এই স্যার একজন আজন্ম স্পোর্টসম্যান), রহমত উল্লাহ স্যার( যাকে আমরা সবাই ডাকতাম মৎস স্যার, কারণ তিনি সব সময় ঠান্ডা থাকতেন, কেউ কখনো দেখে নি তিনি রাগ করেছেন), মজুমদার স্যার (সিভিল উডের এই শিক্ষককে আমরা ডাকতাম রোবোকপ, কারণ তিনি সমানে বুক উঁচু করে সামনের দিকে হাঁটতেন, পেছনে চাইতেন না),  আজাদ স্যার (যিনি পরোপকারী স্যার নামেই খ্যাত, কারণ এই স্যার সর্বক্ষণ শিক্ষার্থীদের আশে পাশে থাকেন এবং সম্ভব সব প্রকার সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন), সেলিম আফরাদ জোয়ার্দার (স্যার সৌখিন মানুষ, তাই আমরা স্যারের পারফিউমের সুবাশ নেওয়ার জন্য যেচে যেচে পাশে গিয়ে কথা বলতাম), আবদুল মান্নান ( এই স্যারকে অল্প সময়ে পেয়েছি, যতদিন পেয়েছি, তাতেই মনে দাগ কেটে নিয়েছেন আন্তরিকতা দিয়ে), প্রদীপ মল্লিক (যিনি ছিলেন টর্নেডো স্যার নামে পরিচিত, চট্রগ্রাম শহর থেকে আসা-যাওয়া করতেন বলে সব কিছু ঘড়ির টাইমে মেইন্টেনেই করতেন), শহীদুল ইসলাম (ম্যাথের জাদুকর নামে পরিচিত এই স্যার অংক ভীতিকে নিমিষেই দূর করতে উস্তাদ), সুজিত বিশ্বাস (এই স্যারকেও প্রায় সবাই শীতল স্যার নামেই আড়ালে ডেকে থাকেন, যিনি অত্যন্ত সজ্জ্বন ব্যাক্তি হিসেবে সবার মাঝে সমাদৃত)। এছাড়াও আরো অনেক আন্তরিকতার সর্বোচ্চ অধিকারী শিক্ষক ছিলেন, যাদের নাম সঠিকভাবে মনে করতে পারছি না বলে দুঃখিত, কিন্তু প্রত্যেকেই স্বতন্ত্রভাবে পিতার অভাব দূর করেছিলেন, দূর করেছিলেন শিক্ষার অন্ধকার দিক, আলো ছড়িয়েছেন আমাদের মস্তিষ্কে, আমাদের বিবেকের দরজায় কড়া নাড়িয়েছেন।

যদি নিজের মনের মত করে লিখতে যাই, একেক জন শিক্ষকের জন্য একেকটি মহাকাব্যে লিখা যাবে, একেক জনের স্মৃতি লিখতে সাগরের জল কলমের কালি হলেও ফুরিয়ে যাবে।

তাই শেষ করছি, আজকের মত। শেষের সেই সীমানা অতিক্রম করছি একজন স্পেশাল শিক্ষকের সম্মানে।

প্রতিটি শিক্ষার্থীদের মাঝে কেউ না কেউ একজন শিক্ষক মনে রয়ে যান, মনে ধরে যান। তেমন একজন আমার প্রিয় শিক্ষক জনাব মাইনুল হুদা সিরাজী স্যার।

অসম্ভব ব্যাক্তিত্ববান এই মানুষটি শুধুই আমার প্রিয় শিক্ষক নন, তিনি যথাক্রমে সকল শিক্ষার্থী, সকল শিক্ষক এবং সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রিয় মানুষ। আমি জানি, তিনি একই সাথে একজন আদর্শ বাবা এবং একজন আদর্শ স্বামী।

রত্নগর্ভা মায়ের সন্তান সিরাজী স্যার সম্পর্কে যারা জানেন, তারা এক বাক্যে স্বীকার করবেন, সকল মানুষের সাথে সদ্ভাব বজায় রেখে, আচরণকে সংযত করে, অপরের প্রতি যত্ন নিতে, অপরের মনে শ্রদ্ধার স্থান করে নিতে তিনিই পেরেছেন।

আমাদের চার বছরের সুইডিশ জীবনে যত ঘটন-অঘটন জন্ম-মৃত্যু হয়েছিল, সিরাজী স্যার সব কিছুতেই নিজের সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীগুলোকে আগলে রেখেছেন, নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন, অন্যায়কে অন্যায় বলতে, ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করতে।

স্যার একই সাথে একজন জাতীয় সাহিত্যিক, ব্যাক্তিজীবনে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে থাকাকালীন ভোরের কাগজের পাঠক মেলার একজন স্বনামধন্য লেখক হিসেব সমাদৃত ছিলেন।

অসাধারণ পড়ুয়া এই স্যারের সাহচার্যে আমিও একজন পাঠক হিসেবে নিজেকে চেষ্টায় নিয়েছি, স্যারের উৎসাহ, প্রেরণা, প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সহযোগিতায় নিজেও কিছুটা সাহিত্যে নামক জগতে পা রাখার দৃষ্টতা দেখিয়েছি।

আমার সকল লেখনির অবদান, আমার প্রিয় শিক্ষক সিরাজীর স্যার নামে খ্যাত অটল বট বৃক্ষের ন্যায় মানুষটি।

সাগরে ঢিল ছুঁড়লে, ঢেউ হতে হতে এক সময় দিগন্তে মিলিয়ে যায়, শেষ দেখা যায় না। সুইডিশ ছেড়ে এসেছি, কিন্তু সিরাজী স্যারের আদর্শ, সাহচার্য লালন করছি, যেন আমৃত্যু লালন করতে পারি।

আমার আজন্ম কৃতজ্ঞতা এবং অভিনন্দন সিরাজী স্যারের প্রতি।

সুইডিশ জীবনের খন্ড খন্ড স্মৃতি অখন্ড হয়ে মস্তিষ্কে চলমান থাকবে, ততদিন পর্যন্ত, যতক্ষণ না মার মস্তিষ্ক স্তব্দ না হয়।

আমার পিতৃতুল্য সকল স্যারের দীর্ঘায়ু কামনা করছি, সৃষ্টিকর্তার কাছে তাঁদের সুস্থতা কামনা করছি।

ভালোবাসা, ভালোবাসা সকলের জন্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *